আক্তারুজ্জামান সুগার। সুগার নামেই পরিচিত সবার কাছে। লন্ডন থেকে বার অ্যাট
ল’ করেছেন। দেশে ফিরে আদালতমুখী না হলেও এলাকার সবাই জানতো একটি ল’ ফার্মে
চাকরি করেন তিনি। কিন্তু এই ব্যারিস্টারের কাজ ছিল সেলিমের অনলাইন গেমিং
সমন্বয় ও টাকার হিসাব রাখা। এটা করতে গিয়ে রাতারাতি বদলে যায় তার নিজের
অবস্থাও। চাকরি ছাড়িয়ে ঢাকার বাসায় নিয়ে আসেন ডাক্তার স্ত্রীকে। তার সময়
কাটতো দেশে-বিদেশে।
থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়াতেই বেশি যাওয়া আসা করতেন তিনি। এছাড়া ঢাকা
থেকে চট্টগ্রামে ছিলো বেশি যাতায়াত। আশপাশের সবাই ভালো-ভদ্র ছেলে হিসেবেই
জানে তাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই থাই ডন সেলিম প্রধানের সহযোগী হিসেবে আলোচনায়
আসেন সুগার। সেলিম ও তার সকল অপকর্মের সঙ্গী সুগার সম্পর্কে এখন ব্যাপক
কৌতূহল সাধারণ মানুষের।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,
দেশে-বিদেশে সেলিমের নানা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আক্তারুজ্জামান
সুগার। অনলাইন ক্যাসিনো থেকে উপার্জিত অর্থ নামে-বেনামে অন্তত তিনটি
একাউন্টে রাখতেন সুগার। পরবর্তীতে টাকা পাঠানো হতো থাইল্যান্ড ও কোরিয়ায়।
সেলিম প্রধানের ব্যবসায়ীক অংশীদার উত্তর কোরিয়ার বাসিন্দা মি. দোর সঙ্গে
একাধিকবার সাক্ষাত হয়েছে সুগারের। দেশে থাকাবস্থায় বাসা ও অফিসের বাইরে
তেমন যেতেন না সেলিম। আর্থিক লেনদেন হতো এমন অনেকের সঙ্গে সেলিম প্রধানের
হয়ে যোগাযোগ করতেন সুগার। এক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েক জনের বিষয়ে
তথ্য পাওয়া গেছে। সেলিম ও সুগারের তথ্য যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ
করবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জয়পুরহাটের সন্তান
আক্তারুজ্জামান সুগার ২০০০ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস
করেন। তারপর ঢাকার ভূঁইয়া একাডেমী থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে বার এট ’ল
করার জন্য ২০০৭ সালে পাড়ি দেন যুক্তরাজ্যে। সূত্রমতে, সেখানেই পরিচয় হয়
সেলিম প্রধানের সঙ্গে। লন্ডনে গেলেই সুগারকে ডাকতেন সেলিম। বারে, হোটেলে
আড্ডায় সুগার ছিলেন তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। পূর্ব লন্ডনে সাক্ষাতকালে মেধাবী
ছাত্র হিসেবে পরিচিত সুগারকে তার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন সেলিম।
যুক্তরাজ্যে
যাওয়ার আগেই লায়লা আর্জুমান্দ আঁখি নামে এক এমবিবিএস ডাক্তারকে বিয়ে করেন।
সম্পর্কে মামাতো বোন। মূলত কৃষক পরিবারের সন্তান সুগার আত্মীয়দের
সহযোগিতায় বার এট ল’ করতে যান। দেশে ফিরে ২০১৬ সালে সেলিম প্রধানের
ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। জয়পুরহাটে সুগারের পরিচিতজনরা
জানতেন, তিনি ঢাকায় একটি ল’ ফার্মে চাকরি করেন। তার স্ত্রী লায়লা
আর্জুমান্দ আঁখি তখন জয়পুরহাটে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার হিসেবে
কর্মরত। সুগার দেশে ফেরার পর তিনি এই চাকরি ছেড়ে দেন। সূত্রমতে, সুগারের
উপার্জন বিপুল। যে কারণে স্ত্রীকে কোথাও চাকরি করতে দেননি। স্ত্রীকে নিয়ে
রাজধানীর বাড্ডায় একটি বাসায় থাকতেন তিনি।
জয়পুরহাটের বাড়িতে থাকেন মা, বাবা ও তার দুই ভাই। বাড়িতে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠাতেন সুগার।
গুলশানে
সেলিম প্রধানের অফিসে নিয়মিত বসতেন তিনি। গুলশানের স্পা সেন্টারটাও
দেখাশোনা করতেন। সেলিমের ব্যবসা ও টাকার হিসাব মূলত সুগারই দেখতেন।
থাইল্যান্ড ও উত্তর কোরিয়ায় সেলিমের হয়ে কাজ করতেন তিনি। অনলাইন ক্যাসিনোর
কোটি কোটি টাকা তার হাত দিয়েই বিদেশে পাঠাতেন সেলিম। তবে সেলিমের পরামর্শ
ছিলো, দেশে তেমন কোনো সম্পত্তি করা যাবে না। তবুও সুগার বগুড়ায় বিলাস বহুল
ফ্ল্যাট কিনেছেন। জমি কিনেছেন বিভিন্নস্থানে।
সুগারের ঘনিষ্ঠরা
জানান, ছাত্রজীবন থেকেই সুগার মেধাবী। ১৯৯৮ সালে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের
গোপীনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্টারমার্ক নিয়ে এসএসসি পাশ করেন তিনি।
ছিলেন বিশ্বাসীও। দেশে-বিদেশে নিশ্চিন্তে তাকে ব্যবহার করতেন সেলিম।
জয়পুরহাটের
ক্ষেতলালের ফোঁপরা সুজাপুরের কৃষক আবু বক্করের সন্তান আক্তারুজ্জামান
সুগার। ৩০শে সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয় সেলিম
প্রধানকে। তিনি ব্যাংককগামী একটি এয়ারলাইন্সের যাত্রী ছিলেন। পরদিন সেলিমের
অফিস ও বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। এসময় আটক করা হয় সেলিমের সহযোগী
আক্তারুজ্জামান ও রোকনকে। অভিযানে ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩
হাজার টাকার সমপরিমাণ ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের
৩২টি চেক, ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, একটি বড় সার্ভার, চারটি ল্যাপটপ ও দুটি
হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং,
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়। বৃহস্পতিবার অনলাইন ক্যাসিনো
ব্যবসার হোতা সেলিম প্রধান, আক্তারুজ্জামান ও রোকনের চার দিনের রিমান্ড
মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকা মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলাম শুনানি
শেষে তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
(ওসি) কামরুজ্জামান জানান, সেলিম, আক্তারুজ্জামান ও রোকনের রিমান্ড মঞ্জুর
হয়েছে। এসব বিষয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসা করা হবে বলে জানান তিনি।