এখন থেকে ৬২ বছর পূর্বে মহাকাশে উৎক্ষেপিত হয় পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১। তৎকালীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো ওই কৃত্রিম উপগ্রহের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়ে একধাপ এগিয়ে গিয়েছিলো মানবসভ্যতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নামে তৎকালীন দুই সুপারপাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। গোটা দুনিয়ায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শন শেষে মহাকাশেও নতুন এক প্রতিযোগিতায় নামে দেশদুটি। আর স্পুটনিক-১ পাঠানোর মধ্য দিয়ে এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দেয় সোভিয়েন ইউনিয়ন।

১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর মহাকাশে সফলভাবে স্পুটনিক-১ প্রেরণ করে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। এটি ছিলো একটি গোল বলের মত দেখতে। ২৩ ইঞ্চি ব্যাসের এই ছোটো উপগ্রহটির ওজন ছিলো ৮৩ কেজি।

এটি পাঠানো হয়েছিলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে। এই দিনটির আগে মানব ইতিহাসে কোনো বস্তুই অভিকর্ষ ছিন্ন করে মহাকাশে যেতে পারেনি। এটির সফলভাবে প্রেরণের মধ্য দিয়ে আমাদের কৃত্রিম উপগ্রহের সফল যাত্রাও শুরু হয়।

উপগ্রহটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতো অবিশ্বাস্য গতিতে। ঘন্টায় ২৯ হাজার কিলোমিটার গতিতে চলতে থাকা স্পুটনিক-১ এর পৃথিবীর চারদিকে একবার আবর্তন করতে সময় লাগতো মাত্র ৯৬ মিনিট। গোলাকৃতির এই উপগ্রহটির একদিকে ছিলো ৪টি এন্টেনা। এগুলো লম্বায় ছিলো ২৩ ইঞ্চি করে। এর নকশা করেছিলেন সের্গেই করালিওভ নামের এক বিজ্ঞানী। মহাকাশে পৃথিবীর চারদিকে এটি পরিভ্রমন করেছে ৩ মাস। এরপর এটিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এর আগে প্রথম ২১ দিন লাগাতার তথ্য পাঠায় স্পুটনিক-১। এরপর এর কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় তথ্য প্রেরণ বন্ধ করে দেয়। এটিই আমাদের প্রথম ধারণা দিয়েছিলো যে, মহাকাশে রেডিও তরঙ্গ কেমন কাজ কাজ করবে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে নভচারী প্রেরণ করলে তারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে কিনা সেটিও এর মাধ্যমে জানা যায়। যাত্রাপথে পৃথিবী থেকে এটি ২১৫ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৯৩৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলো।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে সোভিয়েত ইউনিয়ন তারাহুরো করে স্পুটনিক-১ পাঠিয়েছিলো। নইলে যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিতে পারতো। দাবিমতে, সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা এর সঙ্গে তেমন কোনো যন্ত্রপাতি প্রেরণ করেননি। যত দ্রুত সম্ভব একটি অতি-সাধারণ কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে স্পুটনিককে পাঠানো হয়েছিলো। এটি সোভিয়েত বিজ্ঞানিদের মাঝে অবজেক্ট ডি কোড নামে পরিচিত ছিলো।

যতদূর জানা যায়, স্পুটনিক-১ মিশনটি প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছিলো। উপগ্রহটিকে একটি আর-৭ রকেটে করে মহাকাশে পাঠানো হয়। কিন্তু উৎক্ষেপণের পরপরই রকেটের ইঞ্জিন ঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অনেকটা ভাগ্যক্রমেই কিছুক্ষনের মধ্যেই এটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। উৎক্ষেপণের পর অনেকেই দাবি করেছেন তারা পৃথিবী থেকেই স্পুটনিক-১ দেখতে পেয়েছেন। স্বাভাবিক অবস্থায় এটিকে সাধারণ দুরবীন দিয়েই দেখা যেতো। স্পুটনিকের ধ্বংসাবশেষ পরেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে। লস এঞ্জেলসের এনকিনোতে এক ব্যাক্তি ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার বাড়ির পেছনে কিছু একটা জ্বলছে। ধারনা করা হয় এটি ছিলো স্পুটনিকের একটি অংশ।

যাইহোক, সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সফলতাকে মানবজাতির জন্য এক বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হলেও খুশি হতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এই অগ্রগতিকে তারা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরণের হুমকি হিসেবে নেয়। ওই অবস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রে স্পুটনিক ক্রাইসিস নামে পরিচিত। সোভিয়েতের ওই সফলতার পর মহাকাশ প্রতিযোগিতায় গতি সঞ্চারিত হয়। কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করতে উঠেপরে লাগে যুক্তরাষ্ট্র। শীঘ্রই সফলও হয় তারা। ১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি নিজেদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার-১ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।

তবে এর আগেই ১৯৫৭ সালের ২ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় স্পুটনিক-২। এই কৃত্রিম উপগ্রহেই ছিলো লাইকা নামের সেই বিখ্যাত কুকুরটি। মহাকাশে প্রথম প্রাণী পাঠানোর কৃতিত্বটাও নিয়ে নেয় মস্কো। এরপর ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আরো একধাপ এগিয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে বছর পাঠানো ভস্তক মহাকাশযানে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে গিয়েছিলেন ইউরি গ্যাগারিন। এছাড়া, প্রথম নারী মহাকাশচারী হিসেবে ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভাকে প্রেরণের রেকর্ডটিও সোভিয়েত ইউনিয়নেরই। তবে এতসব জয়যাত্রার সূচনা হয়েছিলো সেই স্পুটনিক-১ এর মধ্য দিয়েই। যেটি পাল্টে দিয়েছিলো মানব সভ্যতার গতিপথ।