একটার পর একটা বিভ্রাট লেগেই আছে। সোনাগাজীর এক মাদ্রাসাছাত্রীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি তাজা থাকতে থাকতেই বরগুনায় আরেকটি তুলকালাম। এর মধ্যে ঢুকে গেল ডেঙ্গু নিয়ে হইচই। এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নৈরাজ্য। সোনার ছেলেদের মার্কটাইম আর কুইক মার্চ তো লেগেই আছে। তার ওপর যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের নানান কেচ্ছা-কাহিনি। এদিকে আবার সবকিছু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ক্যাসিনো-তাণ্ডবে। রোহিঙ্গা নিয়ে রমরমা তর্ক তো আছেই বছরজুড়ে। এক ফাঁকে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে আকাশে উঠলেও অন্যান্য গরম খবরের ভিড় ঠেলে সংবাদ শিরোনামে খুব সুবিধা করতে পারছে না। কাশ্মীর নিয়ে কথাবার্তাও মিইয়ে গেছে। অর্থাৎ, সুস্থির হয়ে যে একটি বিষয় নিয়ে মানুষ ভাববে, গণমাধ্যম আর রাজনীতিবিদেরা কাটাছেঁড়া করবেন, তার জো নেই। একটার পর একটা অঘটন। 
যেগুলো মানুষের চোখে বাজে কাজ, তার প্রায় সব কটিতেই ক্ষমতাসীন দলের লোকদের জড়িত থাকার খবর পাচ্ছি আমরা। ক্ষমতাসীনদের ‘জনপ্রিয়তায়’ ভয় পেয়ে বিরোধীরা নতুন কোনো ‘ষড়যন্ত্রে’ মেতেছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। ছাত্রলীগ কয়েক দিন আলোচনায় ছিল। এখন তার জায়গায় চলে এসেছে যুবলীগ। কয়েকজন নেতা-পাতিনেতা তারস্বরে বলছেন, দলে অনুপ্রবেশকারীরাই হচ্ছে সব নষ্টের মূল। অর্থাৎ, সাধুর আঙিনায় চোর ঢুকে পড়েছে। 
 ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে বেশ কিছুদিন চেঁচামেচি হলো ভারতে। বিশেষ করে আসাম রাজ্যে এনআরসি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই হাওয়া বেশ গরম। ওখানেও অনুপ্রবেশের জুজু। কয়েক বছর ধরেই এর সলতে পাকাচ্ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা। এঁদের সিপাহসালার হলেন অমিত শাহ। তাঁর আঙুল বাংলাদেশের দিকে। 
 ‘অনুপ্রবেশ’ শব্দটি আমাদের রাজনৈতিক বলয়ে খুবই আদরের। তারা নিজেরা তো কোনো খারাপ কাজ করতেই পারে না। অনুপ্রবেশকারীরা এসে খারাপ কাজগুলো করে যাচ্ছে। আসলে খারাপ কাজের দায় কেউ নিতে চায় না। কোনো একটি কাজ ভালো হলে তার সব কৃতিত্ব আমার। আর কাজটা খারাপ হলে, ওটা তুমি করেছ। 
সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা এক দিনে তৈরি হয় না। ধীরে ধীরে এটা গড়ে ওঠে। আমরা যখনই বলি, আমরা ‘উন্নত দেশ’ হব, তখন কিন্তু মডেল হিসেবে
আমাদের চোখের সামনে কিংবা মনের আয়নায় ইউরোপ কিংবা উত্তর আমেরিকা বা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কথাই ভেসে ওঠে। দু-একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রও আমাদের নজরে থাকে। মডেল হিসেবে আমরা ইয়েমেন বা বুরুন্ডিকে নিই না। এমনকি চীন-ভারতও নয়। উন্নত দেশের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কয়েকটি খাতের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়। এগুলো হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা ও গণপরিবহন। এই চারটি যেসব দেশে ভালো, আমরা ওই সব দেশে আমাদের সন্তানদের পাঠানোর কথা ভাবি। 
আমাদের দেশে এই চার খাতে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। আমরা একের পর এক কংক্রিটের স্থাপনা বানাচ্ছি। কিন্তু সমাজটা ভেতরে-ভেতরে রসাতলে যাচ্ছে। বড় বড় দালান, রাস্তা আর সেতু দেখিয়ে আমরা বলি উন্নতি হচ্ছে। অথচ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলো মেটানোর ব্যবস্থা নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন দুনিয়ার হাজারটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই, এ নিয়ে মাথাব্যথা দেখি না। কেউ কেউ এমনও বলেন, আমরা ওই র‍্যাঙ্কিং নিয়ে ভাবি না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চেকআপ করতে ঘনঘন বিদেশে যান। দেশের স্বাস্থ্যকাঠামোয় তাঁদের নিজেদেরই আস্থা নেই। তাঁরা কেউ চান না, তাঁদের সন্তানেরা ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল করুক। যেসব দেশে এই ব্যামো নেই, তাঁদের সন্তানেরা ওই সব দেশে যায়। 
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুব বেশি বলার দরকার নেই। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা গানম্যান বা দেহরক্ষী ছাড়া ঘর থেকে বের হন না। অফিসে আট ঘণ্টা কাজের জন্য চার ঘণ্টা যদি রাস্তায় বসে ঘামতে কিংবা ঝিমুতে হয়, তাহলে গণপরিবহন থাকল কই। আমরা আসলে ভালো নেই। তবে কিছু লোক তো খুব ভালো আছে। তারা সবকিছুই ভালো দেখে। কিছুদিন আগে একটি জরিপে জানা গিয়েছিল, অতি ধনীর প্রবৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ দুনিয়ার তাবৎ দেশের শীর্ষে। একশ্রেণির লোকের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তার সামান্য একটু নমুনা পাওয়া গেল সাম্প্রতিক ক্যাসিনো-কাণ্ডে। 
এ দেশে যেকোনো সমস্যা দেখা দিলেই তা নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। একদল বলে, দেখো দেখো, ওই দল কত খারাপ, তাদের লোকেরা কত খারাপ কাজ করছে ইত্যাদি। তখন দলটি বেছে নেয় আত্মরক্ষার কৌশল। খুবই পুরোনো কৌশল—আমরা সবাই সাফসুতরো; যত নষ্টের মূল হলো তোমাদের দল থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা। এই পিলো পাসিং চলছে বছরের পর বছর। 
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, সরকারব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক। মুখে যে যা-ই বলুক না কেন, কাজে-কর্মে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। দেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের নিয়ে ঘোরতর সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি দেশের বাইরে থাকায় এসব সমস্যার প্রায় সবগুলোই ঝুলে রয়েছে, কোনো সুরাহা হয়নি। আর কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন বলে মনে হয় না। কেননা, দায়িত্বপ্রাপ্তরা হরহামেশাই বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দেবেন। অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো পোস্টবক্স। 
কথা হলো, এই ব্যবস্থা চূড়ান্ত বিচারে কী ফল দিচ্ছে? ভালো কাজ হলে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাঁর দলের লোকজনের
খারাপ কাজগুলোর দায়ও শেষ পর্যন্ত তাঁর সরকারের ওপর গিয়ে পড়ে। সাংবিধানিকভাবে শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিক হওয়ায় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। অনেক দিনের পুরোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষয়ে গেলে তাতে নতুন করে পলেস্তারা লাগিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না। চৌকাঠে একবার ঘুণ ধরলে তার বিস্তার ঘটে সারা বাড়িতেই। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঘুণ ধরেছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে। 
যাঁরা একসময় প্রতিষ্ঠানগুলো চালিয়েছেন, তাঁরা অনেকেই অবসরে গিয়ে এই কথাগুলো বলেন, স্বীকার করেন। কিন্তু দায়িত্বে থাকার সময় যদি একটু মনোযোগ দিতেন, তাহলে অবস্থা অন্য রকম হতেও পারত। কিন্তু সবাই তো জানেন সরকারব্যবস্থা এককেন্দ্রিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ–প্রক্রিয়াও। তাই কোনোমতে বেতন-ভাতা নিয়ে চাকরিজীবনটা পার করে দিলেই হলো। কে যেতে চায় উটকো ঝামেলার মধ্যে। আর কে না জানে, ক্ষমতাসীন দলের চাঁইদের চটালে চাকরি নিয়ে টান পড়ে, শাস্তিমূলক বদলি হয়, প্রমোশন আটকে যায়। 
আমরা কি একটা গভীর খাদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি? কোনো বড় কবির পদ্য আওড়ে মনের মধ্যে আশাবাদ জাগাতে পারছি না। এত রক্তক্ষয়ের পর একটা দেশ পেলাম। এখন যা চলছে, এই কি আমাদের প্রাপ্য ছিল। 
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক