সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি। প্রায় ৪ বছর ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব পালন করে নাজমুল হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। দায়িত্ব পালনের সময় ছিলেন নানা সমালোচনার কেন্দ্রে। দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকেই তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি সামনে আসে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালেই তিনি বেশ কয়েকটি দেশে নিয়মিত ভ্রমণ করতেন। ওইসব দেশে তিনি বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়ান সেই সময় থেকে। সিদ্দিকী নাজমুলের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষুব্ধ হন তার প্রতি। সাধারণত ছাত্রলীগের বিদায়ীরা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা মূল দলে দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। কিন্তু নাজমুল এখন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে। লন্ডনে তিনি ব্যবসায়িক ভিসায় অবস্থান করে সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। সেখানে ব্যবসা পরিচালনা ও তার আলিশান চলাফেরা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে।
সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমে লন্ডনে সিদ্দিকী নাজমুল আলমের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর থেকে তাকে নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে নাজমুল তার নামে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন।
স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী সিদ্দিকী নাজমুল লন্ডনে চারটি কোম্পানীর মালিক। তিনি বিনিয়োগকারীর ভিসায় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। সেখানে বিনিয়োগকারীর ভিসা পেতে হলে কমপক্ষে দুই লাখ পাউন্ড যা বাংলাদেশি টাকায় দুই কোটিরও বেশি বিনিয়োগ করতে হয়। সূত্রের দাবি, ব্রিটিশ সরকারের কাছে নাজমুলের কোটি কোটি টাকার নিবন্ধিত বিনিয়োগ রয়েছে। তার নামে ব্রিটেনের কোম্পানি হাউজে আবাসন, গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট ক্লেইম ম্যানেজমেন্ট, পণ্যের পাইকারি বিক্রেতা, বিজ্ঞাপন, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরণের ছয়টি কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানির পরিচালক পদে তার নাম নেই। বাকি চারটি কোম্পানির মধ্যে একটির একক পরিচালক এবং আরও তিনটি যৌথ পরিচালক হিসেবে নাজমুল রয়েছেন। ফ্লেক্সফগ লিমিটেড, এলিট সিটি লিমিটেড, নাজ ইউকেবিডি প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এসএনবি অটোস লিমিটেড, এসএনআর ইউকে বিডি লিমিটেড ও কার মিউজিয়াম লিমিটেড নামে ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ইস্ট লন্ডনের কেনন স্ট্রিট রোডে নাজ ইউকেবিডি প্রোপার্টিজ নামের আবাসন ব্যবসার একক পরিচালক তিনি। যার মূলধন দেখানো হয়েছে সাড়ে আট লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় যা ১০ কোটি টাকার সমান। কোম্পানিটি ২০১৮ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ সরকারের কোম্পানি হাউজে ১১৪৫৮১৯৯ নম্বরে নিবন্ধিত হয়। এখানে ব্যবসার ধরন হিসেবে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। নিজস্ব প্রোপার্টি কেনাবেচা, লিজ অথবা নিজস্ব প্রোপার্টি ভাড়া দেয়া এবং পরিচালনা করা, রিয়েল এস্টেট এজেন্সি এবং চুক্তি অথবা ফির মাধ্যমে প্রোপার্টি পরিচালনা করা। টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন রোডের পাশে পান্ডারসন গার্ডেনে রয়েছে ফ্লেক্সফগ লিমিটেড নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। যেটি ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি কোম্পানি হাউজে ০৮৮৬৮৬৮১ নম্বরে নিবন্ধন করা হয়। এই ব্যবসার ধরন দেখানো হয়েছে নন স্পেশালাইড হোলসেল ট্রেড, অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি এবং অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি সেবা। যা আগে লিঙ্কমোর ইউকে লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল। এই কোম্পানিতে সিদ্দিকী নাজমুল আলম এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। কোম্পানিতে আরও দু’জন পরিচালক রয়েছেন। তৃৃতীয় কোম্পানি এলিট সিটি লিমিটেড। এটি সেন্ট্রাল লন্ডনের বসওয়েল স্ট্রিটে অবস্থিত। এই কোম্পানিটি ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট কোম্পানি হাউজে ১১৫২১৪৭৩ নম্বরে নিবন্ধিত হয়। এই কোম্পানির ব্যবসার ধরন হচ্ছে এমপ্লয়মেন্ট প্লেসমেন্ট এজেন্সি ও টেম্পোরারি এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি এক্টিভিটিস। এই কোম্পানির জন্মলগ্ন থেকে সিদ্দিকী নাজমুল আলম মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সঙ্গে যৌথ পরিচালক হিসেবে আছেন। চতুর্থ কোম্পানি এসএনবি অটোস লিমিটেড বেথনাল গ্রিনের ২৫ পান্ডারসন গার্ডেনে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১০১৩৭১৫১ নম্বরে কোম্পানি হাউজে নিবন্ধিত হয়। এই কোম্পানির ব্যবসার ধরন হিসেবে বলা হয়েছে রেন্টিং অ্যান্ড লিজিং অব কারস্‌ অ্যান্ড লাইট মোটর ভেহিক্যাল। শুরু থেকে এই প্রতিষ্ঠানেরও পরিচালক হিসেবে আছেন নাজমুল এবং মোহাম্মদ রুহুল আমিন। এছাড়া এসএনআর ইউকে বিডি লিমিটেডে (১০৫১৭৩৫৮ কোম্পানি নম্বর) ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নাজমুল পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেও ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি পদত্যাগ করেন। একইভাবে কার মিউজিয়াম লিমিটেডে (১০২৫৪৪২২ কোম্পানি নম্বর) ২০১৬ সালের ২৮ জুন পরিচালক পদে যোগ দিয়ে তিন দিনের মাথায় ২০১৬ সালের ১ জুলাই পদত্যাগ করেন তিনি।
ব্যাংক উদ্যোক্তা নাজমুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সিদ্দিকী নাজমুল আলম ছিলেন অতি সাধারণ একটি পরিবারের সন্তান। সেই নাজমুলই ২০১১ সালে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে বসার এক বছর পর একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ৩৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা বোর্ডের অন্যতম পরিচালক বনে যান। হঠাৎ করে নাজমুলের এতো টাকার উৎস নিয়ে আলোচনা হয়েছে ব্যাপক। আবার এটি ছিল ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের স্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারায় বলা হয়েছে, বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত কোনো ছাত্র-ছাত্রী ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না। জানা গেছে, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের ৩৯ ব্যক্তি উদ্যোক্তার একজন ছিলেন সিদ্দিকী নাজমুল। প্রতিষ্ঠাকালেই ব্যাংকটির ১০ লাখ শেয়ারের মালিক হন তিনি। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধনে ছাত্রলীগের এ সাবেক সাধারণ সম্পাদক জোগান দিয়েছেন ১ কোটি টাকা।
বঙ্গতাজের পরিবার নিয়ে কুটূক্তি:
চলতি বছরের জুনে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম ওরফে সৌরভের নিখোঁজ হওয়া ও উদ্ধার হওয়া নিয়ে সোহেল তাজের তৎপরতার সমালোচনা করে সিদ্দিকী নাজমুল আলম স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, সোহেল তাজ চাইলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। তাঁর আপন বোন সিমিন হোসেন রিমিও বর্তমানে এমপি। সংসদ অধিবেশনেও যাচ্ছেন। চাইলেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু ফেসবুক লাইভে বার বার এসে কেন এসব করছেন বুঝতে পারছিনা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এবং ওনাদের সমস্যাটা কি বুঝতে পারছিনা। নিজে পদত্যাগ করলেন। ওনার বাবা তাজউদ্দীন আহমেদও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তার চাচা আফসার উদ্দিনও শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ওনার মা জোহরা তাজউদ্দীনও গণফোরামে যাই যাই করছিলেন। এবং শারমিন আহমেদও বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করে বই লিখেছেন। সিমিন হোসেন রিমি এমপিও প্রথম আলোতে এই রকম অনেক কলাম লিখেছেন। অথচ বঙ্গবন্ধু কন্যা ওনাদেরকে সবসময় সম্মান করে যাচ্ছেন।’ সিদ্দিকী নাজমুল আলমের এ স্ট্যাটাস নিয়ে সে সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা।
ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রীও:
সিদ্দিকী নাজমুলের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও। গত বছর এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের মাঝখানে হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের নাম ঘোষণা করায় প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অবস্থায় বক্তব্য শেষ না করেই মঞ্চ ত্যাগ করতে বাধ্য হন সিদ্দিকী নাজমুল আলম।
‘সাংবাদিকরে ক্ষমা করে দিয়েছি: এদিকে লন্ডনে সিদ্দিকী নাজমুলের ব্যবসা নিয়ে সংবাদ প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তিনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যেখানে তিনি লেখেন, ‘তামাশা? লন্ডনে একটা কোম্পানি খুলতে খরচ হয় ১২ পাউন্ড ৪ টি কোম্পানি খুলতে খরচ হয়েছে ৪৮ পাউন্ড বাংলা টাকায় প্রায় ৪৯০০ টাকা যা সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স খুলার চাইতেও কম। আর অপরিশোধিত মূলধন হিসেবে চাইলে আপনি যা ইচ্ছা দেখাতে পারবেন তারপরও আমার কোন কোম্পানির অপরিশোধিত মূলধনের পরিমান ৫/৭ হাজার পাউন্ডের বেশী নয় অথচ কি কাল্পনিক নিউজ? আর কোম্পানী যুক্তরাজ্যে চাইলে যে কেউ খুলতে পারে জাস্ট ২০ মিনিট সময় লাগে অনলাইনে। আমার কোম্পানিগুলোর নাম তো সবাই পেলেন (এখনঈড়সঢ়ধহুযড়ঁংব.মড়া.ঁশ) এখানে গিয়ে দেখলেই বুঝবেন সংবাদের সত্যতা কতটুকু। আরেকটা কথা যুক্তরাজ্যে চাইলেই কেউ কোটি কোটি পাউন্ড ইনভেস্ট করতে পারেনা। আর যে কোম্পানির কথা বলছেন ১০ কোটি টাকার সেটা এখন ঐ সাংবাদিকের কাছে বিক্রি করতে চাই বিনামূল্যে যদি কোন মায়ের বুকের দুধ খেয়ে থাকেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। আমি বললাম তো ঐ কোম্পানীতে এক টাকাও বিনিয়োগ করা হয়নি। শুধু নাম দিয়ে কোম্পানী খুলে রেখেছি। মামলা করলে এদেশে কি পরিনতি হয় তা তো জানেন পন্ডিত সাহেব? দিলামনা আপনার পেটে লাত্থি। কারণ হয়তোবা এস্যাইলাম মেরে থাকতেছেন এই দেশে হাজার মাইল দূরে রেখে আসা পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। আমি চাইলেই পন্ডিত মহাশয়কে আইনের মাধ্যমে শায়েস্তা করতে পারি। আবারও মাফ করে দিলাম কারণ অভ্যাস হয়ে গেছে।