১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করার কথা উঠতেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘সবার আমলনামা আমার হাতে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এই কথা বলার দুয়েক দিনের মাথায় হঠাৎ এক রাতে ঢাকা শহরের স্পোর্টস ক্লাবগুলোর আড়ালে থাকা অবৈধ জুয়ার আসর এবং ক্যাসিনোগুলোতে র‌্যাবের অভিযান শুরু হয়। এ রকম কয়েকটি ক্লাবের অপ্রতিরোধ্য কর্ণধার ও যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি বার্তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। একই অভিযোগে ঢাকা শহর থেকে গ্রেফতার হয়েছে যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও ফিরোজ নামের আরেকজন। এদের অবৈধ টাকার বস্তা আর বিলাসবহুল গাড়ির বহর, সশস্ত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী ও সুরৌম্য অট্টালিকার সচিত্র প্রতিবেদন মানুষ দেখেছে। এ খবর সারা দেশে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ এমনিতেই জানে, তারপরেও খবর বেরিয়েছে এরা শুধু একা নয়, এর সঙ্গে পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষমতাধর অংশের অনেক মন্ত্রী-এমপিও নাকি জড়িত। খবর বেরিয়েছে জি কে শামীম একাই নাকি মাসে ক্ষমতাধরদের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা বিতরণ করত। কিন্তু এখন তার পাশে কেউ নেই। শোনা যাচ্ছে, বড় বড় নেপথ্যের সম্রাটরা নাকি এখন ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছেন। চাচা এখন আপন পরান বাঁচা। সারা দেশ থেকে খবর পাচ্ছি সাধারণ মানুষ বেজায় খুশি। এক আকস্মিক ধাক্কায় বাঁচাধনের জীবনটা ষোলোআনাই মিছে হয়ে গেল। যে পুলিশ হয়তো কয়েক দিন আগেও বড় করে সালাম দিয়েছে, সব অপকর্মের পাহারা দিয়েছে, সেই পুলিশ আজ হাতকড়া পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্যে দিবালোকে। এই দৃশ্য দেখে এই দুর্বৃত্ত এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সত্যিকার মনের অনুভূতির কথা আমার বড় জানতে ইচ্ছা হয়। পরিবারের সবাই তো দেখেছেন জি কে শামীম বা খালেদ মাহমুদের কার্যকলাপ। তারা কি এখন অনুতপ্ত হচ্ছেন, নাকি মনে করছেন আমরা ক্ষমতবান, তাই সবকিছুই আমাদের জন্য জায়েজ, প্রাপ্য। হয়তো ভাবছেন- ক্ষমতাবান হওয়াটা তো চাট্টিখানি কথা নয়, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তাছাড়া ক্ষমতাবান তো সবাই হতে পারে না। এ দুর্বৃত্তদের কর্মকা- ও কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয় এরা হয়তো মধ্যযুগীয় রাজা সম্রাটের মতো নিজেকেই রাষ্ট্র মনে করে। আমিই রাষ্ট্র। আমি যা ইচ্ছা করব। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগে রাষ্ট্রের চাইতে বেশি ক্ষমতবান কেউ হতে পারে না। সেটি হলে রাষ্ট্র টিকতে পারে না। র‌্যাবের অভিযান শুরুর প্রথম দিন এই দুর্বৃত্তদের বড় নেতার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে মনে হয়েছিল তিনিই বোধহয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। কিন্তু দেশব্যাপী মানুষের চরম ঘৃণা ও সমালোচনার পর সেই নেতা সুর নরম করেছেন। এই নরম সুর দেখে মানুষের ধারণা তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন বিপদ আসন্ন। বেশি ঔদ্ধত্য দেখালে শেকড়সহ টান পড়তে পারে। সুতরাং ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি ছাড়া গতি নেই। দলমত নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপের প্রশংসায় ভরপুর। তাতে বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর মেয়ের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা করে। ২০০৯ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দিলেন তিনি তার পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সে পথে তো পাহাড় সমান বাধা এবং সীমাহীন চ্যালেঞ্জ। তিনি জানতেন ১৯৭৫ সালের পর একনাগাড়ে দীর্ঘ একুশ বছর এবং তারপর ২০০১-২০০৬ মেয়াদে একাত্তরের পরাজিত ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী গোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং ধর্ম-কর্ম সর্বত্র মহাজঞ্জাল তৈরি হয়েছে এবং তার ভিতর দিয়ে যেসব অসুরের জন্ম হয়েছে তার কবল থেকে বের করে এনে রাষ্ট্রকে জঞ্জালমুক্ত করা মোটেও সহজ কাজ হবে না। দুই সামরিক শাসকের সর্বনাশা রাজনীতির কলুষ থেকে তার নিজ দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলো যে মুক্ত নয় সে কথাও তিনি জানতেন। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কৌশলী হয়েছেন। এক সঙ্গে বহুফ্রন্টে যুদ্ধ করার পরিণতি তার জানা আছে। ১৮১২ সালে সম্রাট নেপোলিয়ান ও ১৯৪০ সালে হিটলার যদি শুধু পশ্চিম ইউরোপের এক ফ্রন্টে যুদ্ধ সীমাবদ্ধ রাখতেন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট একই সময়ে না খুলতেন তাহলে নেপোলিয়ান ও হিটলারের ভাগ্য অন্য রকমও হতে পারত। হিটলার নেপোলিয়ানের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা একেক করে বড় বড় জঞ্জাল দূর করার কাজে হাত দিলেন। প্রত্যেকটি কাজের পথেই নিজের জীবনের ঝুঁকি জড়িত তা তিনি ভালো করেই জানতেন। ইতিমধ্যে তাকে হত্যা করার কত চেষ্টা হয়েছে তা সবারই জানা। কিন্তু তিনি তো সেই পিতার সন্তান, যিনি অবধারিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সামান্যতম বিচলিত হননি, মৃত্যুকে একটুও ভয় পাননি। বঙ্গবন্ধুর এমন সাহসের কারণেই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। সিটিং রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতাকে হত্যাকারী স্বঘোষিত খুনি। এদের বিচার করা যাবে না বলে আইন হলো, তাদের পুরস্কৃত করে দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দেওয়া হলো। একটা রাষ্ট্রের একটি কত বড় জঞ্জাল তা একবার ভেবে দেখুন। আরও ভেবে দেখুন, যে রাজনৈতিক পক্ষ এসব অপকর্ম করেছে তারা রাজনীতিতে বড় শক্তি নিয়ে অটুট থাকা অবস্থায় ওই খুনিদের বিচার করা কত বড় কথা। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে প্রথমেই এই জঞ্জালটি পরিষ্কার করেছেন। তারপর তিনি আরেক মহাকঠিন জঞ্জাল পরিষ্কারের কাজে হাত দেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই যুদ্ধাপরাধীরা ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে। দেশে-বিদেশে এরা ব্যক্তিগতভাবে এবং দলীয় ফান্ডে পাহাড় সমান টাকা জমিয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক সখ্য তৈরি করেছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সঙ্গে। জামায়াত-বিএনপির সম্মিলিত প্রতিরোধ, বিদেশি শক্তির হুমকি-ধমকি, অনুরোধ উপরোধ অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা মশহুর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ফাঁসির দ- কার্যকর করেছেন। কত বড় কাজ একটু গভীর দৃষ্টিতে ভাবলে তার কূল পাওয়া যায় না। আর কিছু না করলেও এই একটি কাজের জন্য তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তৃতীয়ত, সেই ভয়াবহ দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের বিচার সম্পন্ন করেছেন, যার সঙ্গে যুক্ত আছেন ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের মন্ত্রী এবং সে সময়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থার সর্বোচ্চ কর্মকর্তাবৃন্দ। এই অস্ত্র চোরাচালানের মধ্য দিয়ে শুধু যে দেশের অভ্যন্তরে জঞ্জাল তৈরি হয়েছিল তাই নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিপজ্জনক জঞ্জাল জড়িয়েছে বাংলাদেশকে। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এই জঞ্জাল শেখ হাসিনা পরিষ্কার করেছেন। এসব জঞ্জাল পরিষ্কারের পথে সব রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে জামায়াত-বিএনপি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক পথে না পেরে জামায়াত উগ্রবাদী ধর্মান্ধ জঙ্গি সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়ে দেয়। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত এই জঙ্গিদের অপ্রতিরোধ্য মানুষ হত্যার তা-ব দেখে মনে শঙ্কা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ এবং এত রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র কি তাহলে এই অপশক্তির কাছে হার মানবে। বাংলাদেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই অপশক্তির কোমর ভেঙে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এতগুলো বিপজ্জনক জঞ্জাল পরিষ্কার করতে যতটুকু সময় লেগেছে তা ওই জঞ্জালের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার তুলনায় অনেক কম। শুধু যে জঞ্জাল পরিষ্কার করেছেন তা নয়, এই সময়ে অন্যান্য অনেক বড় বড় অর্জন রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা যখন উল্লিখিত ফ্রন্টগুলোতে যুদ্ধ চালিয়েছেন, সেই ফাঁকে ১৯৭৫ সালের পর দুই সামরিক শাসক ও তাদের বর্তমান প্রতিভূদের তৈরি কলুষিত ও আদর্শহীন রাজনীতি, যার একমাত্র লক্ষ্য টাকার পাহাড় তৈরি করা ও ভোগ-বিলাস, এগুলো আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কিছু নেতা এই কলুষের প্রভাবে কলুষিত হয়েছেন তা নয়, অন্যান্য দল এবং রাষ্ট্রের সব সেক্টরের ক্ষমতাশালী কর্মকর্তাদের বড় এক অংশ দুর্নীতিতে ডুবে গেছেন। রাষ্ট্রীয় সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের হাত করে একশ্রেণির ব্যবসায়ীও দুর্বৃত্তের মতো ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাইতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। মিডিয়াসহ দেশপ্রেমিক সব মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই অভিযান যেন শুধুমাত্র ক্যাসিনোকেন্দ্রিক না থাকে। দুর্বৃত্তদের গডফাদার, গ্রান্ডফাদাররা পরিকল্পিতভাবে বড় কোনো অঘটন ঘটাবার চেষ্টা করতে পারে যাতে সবার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে চলে যায়। দুর্বৃত্ত এবং তাদের সাগরেদ বাহিনী বলছে, কয়েকদিন পরেই সব থেমে যাবে, শেষ বিচারে কিছুই হবে না। তবে বৃহত্তর জনগণের ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত পদক্ষেপই প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। এখান থেকে তিনি পিছু হটবেন তা মনে হয় না। তিনি তো বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। সর্বত্রই মানুষ বলছেন, শেখ হাসিনা অনেক কিছুই করেছেন, যা পূর্বের কেউ করেনি। এখন দুর্নীতির মহামারীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারলে শেখ হাসিনা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন জীবন দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। তিনি এই মুক্ত করার সংকল্পে অটুট থাকার কারণে জীবন দিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার ভিতরে বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতোই সংকল্পবদ্ধ। নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পিতার প্রদর্শিত পথেই হাঁটছেন। বাংলাদেশের মানুষ তার সঙ্গে আছেন। শেখ হাসিনার সাহসের প্রমাণ বাংলাদেশের মানুষ বহুবার দেখেছে। সুতরাং দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে নতুন যুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শুরু করেছেন, সে যুদ্ধে তিনি অন্যান্য যুদ্ধের মতোই জয়ী হবেন। বাংলাদেশের মানুষই তার শক্তি। গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ গোয়েন্দা পুলিশের কাছে যা বলেছেন তার কিছু অংশ কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর। তাতে সে বলেছে, স্যার ধরা যখন পড়েছি তখন চুপ থেকে ফায়দা কী। অন্য আরেকটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে জি কে শামীম নাকি প্রতি মাসে ২৫ কোটি টাকা বিলিবণ্টন করতেন। শেখ হাসিনা কাউকে ছাড়বে না। তাই চারদিকে এখন ইয়া নাফসি ইয়া নাফসির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এখন কেউ কারও দিকে তাকাবে না।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)