চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর কোনো সমন্বয় ছাড়া অনেক বছর ধরেই চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণে অনিয়ম হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে অর্থের অপচয়। দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। চলচ্চিত্রের মন্দার দিনে এই অনিয়ম, অপচয় প্রযোজকের লোকসান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই অনিয়ম আর অপচয়ের লাগাম টেনে ধরছে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। এ জন্য তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাণসংক্রান্ত একটি নীতিমালা। সম্প্রতি এ বিষয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নেতা কামাল মো. কিবরিয়া লিপুকে আহ্বায়ক ও চলচ্চিত্র পরিচালক নেতা বদিউল আলম খোকনকে সদস্যসচিব করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি চলচ্চিত্র নির্মাণসংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালায় একটি ছবি তৈরিতে অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে ছবির শুটিংয়ের সঙ্গে জড়িত প্রোডাকশন ব্যবস্থাপক, লাইট, ক্যামেরাসহ কারিগরি বিষয়গুলোর প্রতিদিনের খরচ উল্লেখসহ শুটিংসংশ্লিষ্ট সব বিষয় রাখা হয়েছে।
এই নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় হলো, এক লাখ টাকার ওপরে যাঁদের পারিশ্রমিক, তাঁরা কোনো যাতায়াত ভাড়া পাবেন না। কলাকুশলীদের অবশ্যই প্রযোজকের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক তিন কিস্তিতে নিতে হবে। প্রথম কিস্তিতে ২৫ শতাংশ ও পরবর্তী দুই কিস্তিতে বাকি ৭৫ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হবে। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শুটিংয়ের সময়। মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি। যদি কোনো শিল্পী বা কলাকুশলী সময়মতো না আসেন, তাঁর জন্য শুটিং শুরু করা না গেলে তার ক্ষতিপূরণ তাঁকেই বহন করতে হবে। কিন্তু শিল্পী আসার পরও যদি নির্দিষ্ট সময়ে ক্যামেরা ওপেন করা না হয়, তাহলে সেই ক্ষতিপূরণ দেবেন পরিচালক। পোশাকের জন্য কোনো শিল্পীকে টাকা দেওয়া হবে না। গল্পের প্রয়োজনে তা প্রোডাকশন থেকে তৈরি করে দেওয়া হবে। শুটিং শেষে প্রযোজকের কাছে পোশাক ফেরত দিতে হবে। কোনো পোশাক শিল্পীর পছন্দ হলে, সেই পোশাক তৈরির খরচ দিয়ে শিল্পী নিতে পারবেন।
ছবির প্রচারণার জন্য প্রধান শিল্পীকে অবশ্যই ছবি মুক্তির আগে পাঁচ দিন শিডিউল দিতে হবে।

নির্মাণসংক্রান্ত এই নীতিমালা সম্পর্কে কমিটির আহ্বায়ক কামাল মো. কিবরিয়া বলেন, ‘একটি ছবি বানাতে গেলে শুটিংয়ে সময় নষ্ট হয়। অর্থের অপচয় হয়। শুটিং ইউনিটে প্রচুর অহেতুক মানুষ থাকে। এতে নির্মাণ ব্যয় বাড়ে। পদে পদে একজন প্রযোজককে নানা কারণে হেনস্তা হতে হয়। তা থেকে রেহাই পেতে, শুটিংয়ের সব দিক থেকে সাশ্রয় করতেই সমিতিগুলো মিলে এই নীতিমালা তৈরির সিদ্ধান্ত।’
কামাল মো. কিবরিয়া আরও বলেন, ‘যদি নীতিমালাসংক্রান্ত বিষয়গুলো মেনে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়, তাহলে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে একজন প্রযোজক, পরিচালক ছবি নির্মাণ করতে পারেন। এতে করে বর্তমান সময়ে যে নির্মাণ ব্যয়, তা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে আসবে। পাশাপাশি একজন প্রযোজক ছবি বানাতে গেলে আগেই বাজেট সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে ছবিতে হাত দিতে পারবেন। বর্তমান সময়ে আমাদের হল সংখ্যা কমে গেছে। কমেছে দর্শক। ফলে প্রযোজক ছবি বানিয়ে প্রতিনিয়তই লোকসান গুনছেন।’
চলচ্চিত্র নির্মাণসংক্রান্ত নতুন ধারাকে স্বাগত জানিয়েছেন ঢাকাই ছবির জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান। তিনি বলেন, ‘এটি ভালো উদ্যোগ। সবকিছু মিলে যদি চলচ্চিত্র তৈরিতে অপচয় অনিয়ম রোধ করা যায়, তাহলে খুবই ভালো।’

এরপর কমিটির আহ্বায়ক কামাল মোহাম্মদ কিবরিয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে এই নায়ক বলেন, ‘ধারাগুলো মানা হলে বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাণ খরচের ৩০ বা ৪০ শতাংশ খরচ কমে আসবে, এটি ভালো; কিন্তু আমার কথা, সেই টাকা যেন প্রযোজক বা কারও পকেটে না ঢোকে। ঢুকলে চলচ্চিত্র একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। ওই টাকা ছবির গুণগত মানের জন্য খরচ করতে হবে। কারিগরি, শুটিং লোকেশন ও ভালো শিল্পী নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ ভালো মানের, ভালো বাজেটের ছবি তৈরি না করতে পারলে সিনেমা টিকবে না। কারণ দর্শকের হাতের মুঠোয় পৃথিবী। তাঁদের কাছে অনেক অপশন এখন।’ এদিকে চলচ্চিত্র মুক্তির সময়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শাকিব খানের কথা, ছবি মুক্তির সময় হলমালিক ও প্রযোজকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ হতে হবে। এতে করে লাখে শতকরা ১০ বা ১৫ ভাগ টাকা বুকিং এজেন্টদের দেওয়া লাগে, তা আর দিতে হবে না। আবার ১৫০ টাকার টিকিট থেকে হলমালিক নিয়ে যাচ্ছেন ১২০ টাকা। যাঁর সিনেমা, সেই প্রযোজক পাচ্ছেন মাত্র ৩০ টাকা। এই হচ্ছে প্রযোজকের হাল। এভাবে চলতে পারে না।

শাকিব খান বলেন, ‘একটি ছবি মুক্তির পর ৩ কোটি টাকা টেবিল কালেকশন থেকে ৩০ লাখ টাকা বুকিং এজেন্ট নিয়ে যাচ্ছেন। প্রযোজকের টাকা হলে পড়ে থাকছে আর কমিশন আগেই নিয়ে নিচ্ছেন বুকিং এজেন্টরা। এসব অনিয়ম দূর করা গেলে ছবি থেকে প্রযোজকের ঘরে টাকা আসবে। তখন ৩ কোটি বা ৫ কোটির সিনেমা তৈরি হবে। আমার কথা, মুক্তির সময় অন্য কেউ যেন প্রযোজকের টাকা খেয়ে নিতে না পারে।’
এদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণসংক্রান্ত ধারাগুলো মাসখানেকের মধ্যেই কার্যকর হবে বলে জানান কমিটির সদস্যসচিব বদিউল আলম। তিনি বলেন, ‘পরিচালক, প্রযোজক পরিবেশক, চিত্রগ্রাহক ও সম্পাদনা সমিতিতে ধারাগুলো পাস হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিসহ আরও দু-একটি সমিতির মতামত নেওয়া হবে। আশা করছি, এক মাসের মধ্যেই নতুন নিয়মে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করা যাবে।’