একসময় রাজধানীর স্পোর্টস ক্লাবগুলো ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বেশির ভাগই ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আশপাশে। আশির দশকের শেষদিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্টেডিয়াম এলাকা থেকে সরিয়ে ক্লাবগুলোর জায়গা করে ফকিরেরপুল, আরামবাগ ও মতিঝিলে। এরপর থেকে এ এলাকার নাম হয়ে যায় ক্লাবপাড়া। বিস্তৃত এ জায়গায় আছে এক ডজনের মতো ক্লাব। এখন আর ক্লাবগুলোতে ঢুঁ মারলে ক্রীড়াবিদ পাওয়া যায় না। খেলোয়াড়দের অন্য জায়গায় রেখে সেখানে জুয়ার বোর্ড আর ক্যাসিনোর ব্যবস্থা করছে কয়েকটি ক্লাব। মোহামেডান, মেরিনার্স ও আরামবাগ খেলাকে প্রাধান্য দিয়ে কার্যক্রম চালালেও অন্য ক্লাবগুলোতে যেন জুয়াই সব। বছর পাঁচেক আগেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। যে ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো বাণিজ্য চলে সেখানকার সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা স্বেচ্ছায় ক্যাসিনোর জন্য জায়গা দেয়নি। জোর করেই ক্যাসিনোর জন্য জায়গাগুলো নেয়া হয়েছে। এখানে কোটি কোটি টাকার জুয়া চললেও ক্লাবগুলো আসলে তেমন কিছু পায় না। অর্থের পুরোটাই চলেযেত কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোল্লা আবু কায়সার, মগানগর যুবলীগ দক্ষিনের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ মাহমুদ ভুইয়া, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুমিনুল হক সাঈদদের পকেটে। এসব ক্যাসিনো দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, জামাল, ইমরান নামে স্থানীয় কিছু যুবলীগ নেতা।
দীর্ঘদিন ধরেই মোহামেডানের কমিটি দখলে রেখেছেন লোকমান হোসেন ভুঁইয়া। নানা অজুহাতে ক্লাবটিতে নির্বাচনও দিচ্ছেন না তিনি। ক্লাবটির সভাপতি ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমও তার কাজে কোন প্রকার বাধাঁ দিচ্ছেন না। ক্লাবে আসা ছেড়েই দিয়েছেন এ ব্যবসায়ী। তার নিষ্ক্রীয়তায় ক্লাবটিতে যা ইচ্ছে তাই করছেন লোকমান হোসেন। লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার কারণেই যে কেউ ক্লাবটির কমিটিতে ঢুকতে পারেন না। এই সুযোগ নিয়েই জুয়াড়িদের হাতে ক্লাবটি ছেড়ে দিয়েছেন লোকমান হোসেন ভুইয়া, এমনই মন্তব্য করেছেন সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও বাফুফের সহ-সভাপতি  বাদল রায়। লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার কারণে ক্লাবটি সরাসরি নিজেদের দখলে নিতে পারেননি ক্যাসিনো ব্যবসায়ীরা। তবে তারা ক্লাবটির ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভুঁইয়াকে ম্যানেজ করেই এখানে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়েছেন বলে জানান এবং ক্লাব পরিচালক। এক বছর আগে মোহামেডানের অডিটোরিয়ামে এই ক্যাসিনো শুরু হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্লাবটির পিয়ন। পিয়ন আরো জানান, শুরুতে ক্লাবের অভ্যন্তরে ক্যাসিনো বসাতে চেয়েছিল দক্ষিন যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চোৗধুরী সম্রাট। জানাগেছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন মুমিনুল হক সাঈদ। তিনি ক্লাবটির কাউন্সিলর হয়ে অংশ নিয়েছিলেন হকি ফেডারেশরনর নির্বাচনে। কিন্তু বেশিরভাগ পরিচালকের আপত্তির কারণে সেখানে ক্যাসিনো বসানো সম্ভব হয়নি। ক্লাবটির পরিচালকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ব্যবসায়ী আবুল কাশেম ও মতিঝিলের স্থানীয় যুবলীগ লীগ নেতা ইমরানের মালিকানায় মোহামেডান ক্লাবে চলছিল এই ক্যাসিনো। এর  নেপালি অংশীদার ছিলেন কৃষ্ণা। রাজধানীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক ক্যাসিনোটিতে চারটি ভিআইপি কক্ষছিল।
 মোহামেডানের মতো ভিক্টোরিয়ায়ও ভাড়ায় ক্যাসিনো চালানো হতো বলে জানিয়েছেন ক্লাবের এক কর্মকর্তা। তার দাবি সরাসরি ক্লাবের কেউ এই ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না। বর্তমান সরকার প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পরই আরামবাগ ক্লাব থেকে বিতাড়িত হন এসএ সুলতান। বাফুফে’র সাবেক এই সভাপতিকে ক্লাব থেকে বিতাড়িত করেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা মমিনুল হক সাঈদ। পরবর্তীতে স্থানীয় কাউন্সিলর হয়ে আরো দুটি ক্লাবকে নিজের কব্জায় নেন তিনি। শোনা যাচ্ছে সাঈদের নেতৃত্বেই দিলকুশা ও আরামবাগ ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা জামাল। প্রিয় ক্লাবটির এই লজ্জা উন্মোচনের পর হতাশ এসএ সুলতান বলেন, ‘আসলে আমি কল্পনাও করতে পারছি না আমার হাতে গড়া ক্লাবটিতে এভাবে ক্যাসিনো চলতো। যে ক্লাবটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, সেই ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাব নিজেদের খেলাধুলা ফুটবলে সীমাবদ্ধ রেখেছে সব সময়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ থেকে প্রিমিয়ার লীগে নাম লিখিয়েছিল ক্লাবটি। কিন্তু অর্থের অভাবে দল গড়তে না পারায় তারা শীর্ষ লীগ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। বর্তমানে ক্লাবটি দ্বিতীয় স্তরেই খেলছে। ইয়ংমেন্স ক্লাবের দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক মনজুর হোসেন মালু নিজের কষ্ট লুকাতে পারেননি, ‘এই ক্লাবটা আমাদের বড় ভাইরা আমাদের বাড়িতে বসেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দু’বার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। যতদিন ছিলাম ততদিন ক্লাবে কোনো প্রকার অবৈধ কিছু হতে দেয়নি। একটা সময় এই ক্লাবটি পরিচিত ছিল ফুটবলার গড়ার কারখানা হিসেবে। অথচ ভাবতেই লজ্জা লাগে আমাদের প্রাণের ক্লাবে এতদিন এসব অবৈধ কাজ হয়েছে।’ ২০০৯ সালে মনজুর হোসেন মালুর হাত থেকে ক্লাবটি দখলে নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নাসিরুল ইসলাম পিন্টু। বর্তমানে ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সাব্বির আহম্মেদ। সভাপতি দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া। আর ক্লাবটির গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। এদের অধীনেই দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাবটিতে চলে আসছিল ক্যাসিনো। ভিক্টোরিয়ায় ক্যাসিনো শুরু হয় ২০১৬ সালে। ক্যাসিনোর শুরুর সময় ক্লাবটির সভাপতি ছিলেন শওকত আলী খান জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাজহারুল ইসলাম তুহিন। বর্তমানে শওকত আলী খান জাহাঙ্গীর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হলেও সাধারণ সম্পাদক আছেন তুহিন। বছর দুয়েক আগে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন খালেদ রহমান কাজল। গুঞ্জন আছে বর্তমান কমিটিকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে এখানে ক্যাসিনো চালান ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সভাপতি কাজল ও সাধারণ সম্পাদক তুহিন প্রতিদিন ভাড়া হিসেবে দেড় লাখ টাকা পেতেন। ক্লাবটিতে অভিযান চালানোর পর থেকে এদের কারো ফোনই খোলা পাওয়া যায়নি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোল্লা আবু কায়সার ও জয় গোপাল সরকার ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো বসিয়েছেন বছর তিনেক আগে। ক্লাবটির সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের ক্লাবটিতে প্রবেশ এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। আমরা জানতামই না এখানে কি হচ্ছে। খেলাধুলার চেয়ে ক্যাসিনোতে মনোযোগ বেশি ছিল দিলকুশার। ক্লাবটির সভাপতি ছিলেন মুমিনুল হক সাঈদ আর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান। এদের মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়েই ক্লাবটিতে ক্যাসিনো চালাতেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা আরমান। ক্লাবের সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এখানে আগে থেকেই জুয়া চলতো। তবে ক্যাসিনো বসেছে বছর তিনেক আগে। এ ক্যাসিনোর মালিক নেপালি নাগরিক দীনেশ। এই ক্যাসিনো থেকে সম্রাটের প্রতিদিনের চাঁদা ৪ লাখ টাকা। এর বাইরে আরমানের নিজের চাঁদা ১ লাখ।
এক ক্লাবের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভাই সবই জানেন। এখানে কারা ক্যাসিনো চালায়। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা উড়ছে। জুয়াড়িদের খাওয়া আর ফুর্তির জন্য প্রতিদিন দেড়/দুই লাখ টাকা খরচ হয়। ক্লাবকে দেয়, সেটাকে ‘ভিক্ষাই’ বলা যায়। আমরা না পারছি গিলতে, না পারছি উগড়াতে। বরং যারা এখান থেকে কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের চেয়ে বদনামটা বেশি ক্লাবেরই।’ ক্যাসিনোতে প্রতিদিন কি পরিমাণ টাকা ওড়ে তার একটা উদাহরণ দিয়ে আরেক ক্লাব কর্মকর্তা বলেন, ‘যে ছয়টি ক্লাবে ক্যাসিনো আছে সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারের মতো মানুষ খাওয়া-দাওয়া করে। এর মধ্যে দুপুর আর রাতের খাওয়াটা নাকি বিয়ে বাড়ির মতো। সবাইকে জামাই আদর করেই খাওয়ানো হয়। যেখানে আপ্যায়নে এত খরচ, সেখানে কি পরিমাণ টাকা উড়ে?’
ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো গড়ে ওঠার পর সবার ধারণা ছিল ক্লাবগুলো এখান থেকে মোটা অঙ্কের দান মারছে; কিন্তু বুধবারের ক্যাসিনো উচ্ছেদ অভিযানের পর বেরিয়ে আসছে আসল তথ্য। ক্লাবের প্রকৃত সংগঠকরা এ অভিযানে খুশি। তারা আগে কিছু বলতে পারেননি। এখন ভয়ে ভয়ে হলেও মনের কথা বলছেন- এগুলো উচ্ছেদ হলেই বাঁচি। তাহলে ক্যাসিনো থেকে ক্লাবগুলো কি পাচ্ছে? এ প্রশ্নও উঠছে। এখানে সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,  দৈনিক সর্বাধিক দেড় লাখ টাকা পেতো ভিক্টোরিয়া ক্লাব। মোহামেডানের ফান্ডে যেত ৫০ হাজার।  এখানেই পরিষ্কার, একটা ক্যাসিনোতে প্রতিদিন আপ্যায়নের যে খরচ তার চার ভাগের এক ভাগও যায় না ক্লাব তহবিলে। অথচ এখন বদনামের পুরোটাই তাদের।