দেশের উচ্চবিত্ত কিছুসংখ্যক মানুষের মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে আছে বেশির ভাগ
সম্পদ। বর্তমানে মাত্র ২৫৫ জন ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ সম্পদ
আটকে আছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক
মইনুল ইসলাম। একই সঙ্গে বছরে দেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দাবি
করেন তিনি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আয়োজনে ‘বাংলাদেশে
ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য: সমাধান কোন পথে?’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ
উপস্থাপনকালে মইনুল ইসলাম এসব কথা বলেন। গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স
ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সমিতির সভাপতি ড. আবুল
বারকাতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক
গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি
বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিক উজ জামান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা
প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুর্শিদ, অর্থনীতি সমিতির
সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ ও সহসভাপতি এজেডএম সালেহ আলোচনায় অংশ
নেন।
ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এক সময় বাংলাদেশের একমাত্র রপ্তানি পণ্য
ছিল পাট। কিন্তু এখন তা পোশাক শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। দুঃখজনক হলো ২০১৭
সাল পর্যন্ত দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ গার্মেন্ট
মালিকরাই। তিনি বলেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আয় বাড়ার হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি
বাংলাদেশে। বছরে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রে এগিয়ে
রয়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা। কিন্তু এই খাতের ৩৫ লাখ শ্রমিক আগের মতো
দরিদ্রই থেকে গেছেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছে
প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। তিনি বলেন, মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোমের মালিক এবং
টরেন্টোর ‘বেগম পাড়ার’ বাড়ির মালিকদের মধ্যেও দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ার,
সিভিল আমলা, সামরিক অফিসার, অর্থনীতিবিদদের পরিবারের পাশাপাশি গার্মেন্ট
মালিকদের পরিবারই বেশি অনুপাতে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। তিনি জানান, পরিসংখ্যান
ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ীও দেশে প্রকট আকারে বৈষম্য বাড়ছে। যা স্বীকার করেন
সম্মেলনে উপস্থিত অন্যান্য বক্তারাও।
ড. মইনুল বলেন, রিয়েল এস্টেট
নির্মাণশিল্প, টেলিভিশন চ্যানেল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিকেল
কলেজ, প্রাইভেট ব্যাংক-বীমা, প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ,
কিন্ডারগার্টেন, সংবাদপত্র, এনজিও, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিলাসী পরিবহন,
হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দেশের দ্রুত বর্ধনশীল
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষক শ্রমিকদের জীবনমান
উন্নত হওয়ার চেয়ে ক্রমাগতভাবে নিচের দিকে নামছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে
প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে
পিতা-মাতার আর্থিক সামর্থের উপর সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মান নির্ভর
করে। যা একটি দেশের জাতিগত উন্নয়নে মোটেও কাম্য নয়।
মইনুল ইসলাম জানান,
৮.১৩ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বাহাদুরি করার
কিছু নেই। বাহাদুরি না করার কারণ হিসেবে অধ্যাপক মইনুল বলেন, এই
প্রবৃদ্ধির হার সত্ত্বেও দেশে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন একটি ‘উচ্চ
আয়-বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক
স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সুবিধাসমূহ, সামাজিক সূচকসমূহ, সচ্ছতার অঙ্গীকারসমূহ
এবং নিরাপত্তা রক্ষাকবচ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রবন্ধে বলা হয়, ২০১৮-১৯
অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে বলে সরকারিভাবে
প্রাক্কলিত হয়েছে। এ বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম গতিশীল অর্থনীতিতে পরিণত
হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে ব্যাপক হারে। আয় বৈষম্য বাড়তে
থাকার এ প্রবণতাকে দেশের আসন্ন মহাবিপদ সংকেত বললে অত্যুক্তি হবে না।
সাড়ে
তিন দশক ধরে সর্বশক্তি দিয়ে এ বিষয়ে জাতির মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেও
তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, এ কথা উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম বলেন, দেশে কোটিপতিদের
সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর পেছনে ন্যক্কারজনক পন্থা হলো দুর্নীতিতে নিমজ্জিত
হওয়া। এমন কোনো সরকারি সংস্থার নাম করা যাবে না, যেটা খানিকটা
দুর্নীতিমুক্ত। এ ছাড়া বর্তমান জাতীয় সংসদে সাংসদদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। এ
সংসদ ব্যবসায়ীদের সংসদ এবং রাজনীতি এখন লোভনীয় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতি
উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা উল্লেখ করে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর
হত্যার মধ্যে দিয়ে দেশে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ ও পুঁজি লুণ্ঠনের যাত্রা শুরু
হয়। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে গত ৪৪ বছরে দেশে লাখ লাখ ব্যবসা
নির্ভর পুঁজিপতি, মার্জিন-আত্মসাতকারি রাজনৈতিক নেতাকর্মী, দুর্নীতিবাজ
আমলা এবং সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদার রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধনাঢ্য ও
উচ্চবিত্ত গোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। তিনি বৈষম্য বৃদ্ধির শক্তিগুলোকে
শক্ত হাতে প্রতিরোধ করার জন্য রাষ্ট্রকে জনগণের স্বার্থের পাহারাদারের
ভূমিকা পালনে বাধ্য করতে হবে বলে অনুরোধ জানান। মইনুল ইসলাম বলেন, আয় ও
সম্পদ বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে হলে দূর্নীতি নিরসন করতে হবে। এর জন্য সকলকে
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান তিনি।
প্রধান অতিথির
বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন আহমেদ বলেন,
মাতৃমৃত্যুর হার ছাড়া মানব উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার
সবচেয়ে ভাল অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু দেশে ক্রমান্বয়ে আয় বৈষম্য বেড়ে চলেছে।
কেবল মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নকে বিচার করলে চলবে না। যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত
হচ্ছে, তার ভাগ যেন সমাজের প্রান্তিক মানুষ পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বণ্টনের ন্যায্যতাসহ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে যেতে হবে। কাউকে
পেছনে ফেলে রেখে প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় সোয়া ১
কোটি মানুষের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের ওপরে। অথচ কর দেন মাত্র ২০ লাখ
মানুষ। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে উচ্চ আয়ের মানুষের কাছ থেকে কর আদায় বিশেষ করে
প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা কার্যকর করতে শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। ব্যাংকিং
খাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ৯০ এর দশকে সবচেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল
ব্যাংকিং খাতের জন্য। স্বল্পমেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বিতরণ কোন
দেশের জন্য সুখকর হতে পারে না। যেকোনোভাবে এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করা
উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনতা ব্যাংকের সদ্য
দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন (এফসিএ) বলেন, দেশে এখনো
দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করার মতো শক্তিশালী কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি।
শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ইনভেস্টমেন্ট করপোরশন বাংলাদেশ (আইসিবি) কোনো ভূমিকা
পালন করতে পারছে না। ফলে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। এসব সমস্যা
সমাধানের দীর্ঘমেয়াদী বন্ড মার্কেট এবং শেয়ার বজার উন্নত করার পরামর্শ
দিয়েছেন জামাল উদ্দিন।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত সম্পদ
বণ্টনের ন্যায্যতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, রাষ্ট্রকে কেবলমাত্র
প্রবৃদ্ধির পূজা করলে হবে না। সেই প্রবৃদ্ধি দিয়ে আসলে মানব উন্নয়ন হচ্ছে
কি-না সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, ধরুন দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হলো, কিন্তু
সেটা যদি সমাজের নিচু তলায় না যায়, তাহলে এই প্রবৃদ্ধি দিয়ে কোন লাভ নেই।
তিনি আংশকা প্রকাশ করে বলেন, নব্য উদারবাদী পুঁজিবাদ অর্থনীতিকে ধংবসের
দিকে নিয়ে যেতে পারে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুর্শিদ সমাজে আয় ও
সম্পদ বৈষম্য নিরসনে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যায়ভিত্তিক ও নিরপেক্ষভাবে
কাজ করার আহবান জানান।
প্রবন্ধে বলা হয়, পরিমাপকের গতি-প্রকৃতির
মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আয়-বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠির
বিপক্ষে এবং ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি
ফুটে উঠেছে: ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র
০.৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে
দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে
তা মাত্র ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে। সমস্যার আরেক পিঠে দেখা যাচ্ছে, দেশের
ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ,
যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আরো দুঃখজনক হলো- জনগণের
সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১৬ সালে চলে গেছে মোট জিডিপি’র
২৭.৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ।
প্রবন্ধে উল্লেখ্য করা
হয়, গত ৫ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গণচীনে ও হংকংয়ে,
কিন্তু ধনকুবেরের সংখ্যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ১৭.৩ শতাংশ
বাংলাদেশে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ধনকুবেরের সংখ্যা ছিল
২৫৫ জন। ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক
বাংলাদেশের পা’মা বা পালমা অনুপাত নির্ণীত হয়েছে ২.৯৩, যার ফলে বলা যায়
বাংলাদেশ এখন ‘বিপজ্জনক আয়-বৈষম্য’ এর স্তরের খুবই কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।