র‌্যাবের জেরার মুখে টেন্ডার কিং জি কে শামীম বলেছেন, ‘আমাকে হত্যার জন্য দুবাই থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর এই পরিকল্পনা করেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। হত্যার জন্য অস্ত্রপাতিও কেনা হয়েছিল। এ খবর জানতে পেরে সাতজন দেহরক্ষী রাখি।’ এদিকে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে যুবলীগসহ শাসক দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে গোয়েন্দারা। তবে নতুন আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মোহামেডান ক্লাবের সদস্য সচিব লোকমানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তার কাছ থেকে ক্লাব-সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম পেয়েছে। যাদের গ্রেফতারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, জি কে শামীমের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দীর্ঘদিন ধরে দুবাই রয়েছেন। ভারতীয় পাসপোর্টে তিনি সেখানে অবস্থান করে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। তার পাসপোর্টে নাম-পরিচয় পাল্টে ভারতীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করে। পাসপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান নিজের নাম বদলে আলী আকবর চৌধুরী নামে ভারতীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঠিকানা দেখিয়েছেন শারদা পল্লী, ঘানাইলা, মালুগ্রাম শিলচর, চাষার, আসাম। বাবার নাম হাবিবুর রহমান চৌধুরী ও মায়ের নাম শাফিতুন্নেছা চৌধুরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর স্ত্রীর নামের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে রিনাজ বেগম চৌধুরী। পাসপোর্ট ইস্যুর স্থান দুবাই উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালের ৭ জুন পাসপোর্ট প্রদান করা হয় এবং পাসপোর্ট মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ হলো ২০১৯ সালের ৬ জুন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এই পাসপোর্টের মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফের ভারতীয় নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন তিনি। নতুন পাসপোর্টটিও ১০ বছর মেয়াদি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুবাইয়ে জিসানের দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেখানে তার গাড়ির ব্যবসাও রয়েছে। এ ব্যবসা দেখভাল করেন তার আপন ছোটভাই শামীম ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাকিল মাজহার। এই মাজহার সূত্রাপুর যুবলীগ দক্ষিণের সহ-সম্পাদক রাজিব হত্যাকান্ডের আসামি। রাজিব হত্যার পর পালিয়ে দুবাই যান তিনি। এদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে অপরাধ জগতের চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ঘিরেও অনেক তথ্য উঠে আসে। সূত্র জানায়, জি কে শামীমকে ঘিরে ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। এই সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ ও আস্তাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বিরোধের একপর্যায়ে জিসান চরম ক্ষুব্ধ হন তাদের ওপর। অবস্থা ভিন্ন দিকে যাওয়ার আশঙ্কায় জিসানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে সমঝোতা বৈঠকের আয়োজন করেন খালেদ। গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সিঙ্গাপুরে যান জি কে শামীম, মহানগর যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতা এবং খালেদ। আর জিসান দুবাই থেকে সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে এলাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে তাদের বৈঠক হয়। তবে তাদের কাক্সিক্ষত ফলাফল ছাড়াই দেশে ফিরতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কিলিং মিশনে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন জিসানের সহযোগীরা।
এদিকে র‌্যাবের হাতের সাতজন অস্ত্রধারী দেহরক্ষীসহ গ্রেফতার হন জি কে শামীম। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীমও জানিয়েছেন, তিনি আগে কখনো এত দেহরক্ষী রাখেননি। মূলত জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে ভয়ে বড় নিরাপত্তা টিম গঠন করেন জি কে শামীম। জি কে শামীমের আরেক ক্যাডার সরদার আলী মিন্টু। মিন্টু ২০১৫ সালে যুবলীগে যোগ দেন। যুবলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। হয়ে যান যুবলীগ নেতা। জন্মভূমি গোপালগঞ্জ হওয়ায় সহজেই আওয়ামী লীগের লোক বলে পরিচিতি পায় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে। শুরু করেন বিভিন্ন অপকর্ম। পরে এসব অপকর্ম জানাজানি হলে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রোগ্রামে মিন্টুর অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়। সম্পর্ক হয় জি কে শামীমের সঙ্গে। হয়ে যান ক্যাসিনো মিন্টু। তার বাবা গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী সদর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম সরকার। জি কে শামীম গ্রেফতারের পর গা-ঢাকা দেন মিন্টু। এদিকে, এক সময়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপানো কেউ এখন বিদেশে, কেউ জেলে। তালিকভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম জিসান। খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীম ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আরও রাঘববোয়াল টার্গেট হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। যাদের আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে চলমান অভিযান আন্ডারওয়ার্ল্ডেও নতুন সমীকরণের বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।