অনেক অনেক দিন আগের কথা। এই অঞ্চলে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিল এক দয়াবতী
রানি। এলাকার মানুষের পানীয়জলের কষ্টের কথা শুনে তিনি কষ্ট পেলেন। পণ
করলেন, তিনি প্রজাদের জন্য একটি দিঘি কাটবেন। ঘোষণা করলেন, তিনি হাঁটবেন।
যতক্ষণ না হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পা ফেটে রক্ত বের হবে, ততক্ষণ তিনি হাঁটবেন।
যেখান থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু করবে, হাঁটা শুরুর জায়গা থেকে সেখান পর্যন্ত
দিঘি খনন করা হবে। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। সবাই বুঝে গেলেন, এত সহজে
রানির পা ফেটে রক্ত বের হবে না। তখন পেছন থেকে কেউ একজন রানির পায়ে আলতা
ঢেলে দিয়ে বলল যে রানির পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে! রানি থেমে গেলেন। তাঁর
হাঁটার শুরু থেকে সেই আলতারাঙা পা পর্যন্ত দিঘি খোঁড়া হলো। সেই থেকে
প্রজারা এই দিঘির নাম দিয়েছে ‘আলতাদিঘি’। ধীরে ধীরে সে দিঘি ভরে গেল টলটলে
কাকচক্ষু জলে। তাতে পদ্ম ফুটল। প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট শেষ হলো।
কিংবদন্তিই বটে। তবে আমাদের দেশের এ রকম প্রায় সব বড় দিঘির সঙ্গে
কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে। এই দিঘিগুলো বহন করে চলেছে রাজা-রানি, জমিদারদের
স্মৃতি। হয়তো আমরা তাঁদের নাম ভুলে গেছি। কিন্তু দিঘিগুলো থেকে গেছে কালের
সাক্ষী হয়ে। এ রকমই একটি দিঘি নওগাঁ জেলার আলাতাদিঘি। এ দিঘি দেখতে গেলে
রানির গল্পটা আপনি শুনতে পাবেন লোকের মুখে মুখে। কিন্তু কোন সে রানি, কী
নাম ছিল তাঁর, সেটা জানতে পারবেন না।
ছোট্ট একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, নওগাঁ গেলে লুকানো আভিজাত্যের
পদ্মফোটা এই আলতাদিঘি অবশ্যই দেখতে যাব কোনো একদিন সকাল সকাল। তো নওগাঁ
যাওয়ার পর এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বেরিয়ে আলতাদিঘি যাওয়ার বাস
পেলাম না। ঈদের পরদিন অন্যান্য দিনের মতো বাস থাকে না। আমিও ছাড়ার পাত্র
নই। নওগাঁ থেকে বাসে করে প্রথমে নজিপুর, তারপর আবার বাস বদলে জয়পুরহাটের
বাসে উঠে বসলাম। পথ চলতে শুরু করতেই পথের দুপাশের সবুজ ধানখেত দেখে মুগ্ধ
হলাম। দুপাশে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ প্রান্তরের সঙ্গে
মিলেমিশে আছে ঝকঝকে নীল আকাশ।
দুই বাস মিলিয়ে সময় নিল দেড় ঘণ্টা। কালুপাড়া সীমান্ত ফাঁড়ির মোড়ে নামিয়ে
দিল। সেখান থেকে অটোরিকশায় চেপে বসলাম। ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো রাস্তার
ঝাঁকুনি ভুলিয়ে দিয়েছে দুপাশের সবুজ প্রকৃতি। বেশ ঘন বন, সবুজ ধানখেত আর
উদাসী বাতাস। পথ চলতে রাস্তার দুপাশে গাছ আর ঘাসের ছুঁয়ে যাওয়া আর মাঝে
মাঝে ভাঙা পথের ঝাঁকুনি খেতে খেতে ভীষণ অবাক করে দিয়ে চোখে পড়ল ঘন বনে ঢাকা
বড় বড় গাছ। একের পর এক বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে আচ্ছাদিত এক অভয়ারণ্য যেন!
বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। যেন অজানা কোনো গহিন বনের মধ্যে ঢুকে
পড়েছি ভুল করে।
এমন নিখাদ বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কিছু দূর পর চোখে পড়ল আলতাদিঘি
অভয়ারণ্যের সরকারি সাইনবোর্ড। তার মানে প্রতীক্ষিত আলতাদিঘিতে প্রবেশ
করেছি। ভাবতেই দারুণ আনন্দ হলো। সঙ্গে একধরনের অস্থিরতা। অনেক অপেক্ষার
কিছু যখন সামনে আসি আসি করে আমার সব সময়ই কেমন যেন একটা অস্থির অনুভূতি হয়।
এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। এমন নিখাদ বন, ঘন অন্ধকার, চারপাশের মিহি
সবুজ, নীরব, নির্জন গ্রামের পথ পেরিয়ে একটা জায়গায় অটোরিকশা আমাকে নামিয়ে
দিল। আমাকে দেখিয়ে দিল যে পথে নেমেছি সেই পথ ধরে সামনে এগোলেই চার-পাঁচ
মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাব আলতাদিঘি।
দুই থেকে তিন মিনিট হেঁটে সামনে এগিয়ে একটি বাঁক নিয়ে অন্য বাঁকে
পৌঁছাতেই লোকজন দেখে কৌতূহল হলো, পৌঁছে গেছি নাকি! আমার এক পাশে গভীর বন আর
অন্য পাশে গাছগাছালি, খেতের মাঝের আলের ওপারে বাঁশগাছের ফাঁকফোকর দিয়ে
টলটলে জলে শেষ দুপুরের সূর্যের আলোর ঝলকানি এসে লাগল চোখে। কী ওখানে? একটু
ভালো করে তাকাতেই দেখি দিঘির টলটলে জল ঢেকে রেখেছে বড় বড় সবুজ পাতায়। আর
সেই বড় বড় পাতার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সাদা, গোলাপি পদ্মের দল! দেখেই চোখ
জুড়িয়ে গেল। আহা, আলতাদিঘি!
ঝটপট রাস্তা ছেড়ে বনের ভেতর দিয়ে, খেতের আল ভেঙে আলতাদিঘির পাড়ে চলে
এলাম। এত বিশাল! এত বিশাল যে দিঘির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঠিকমতো
দেখাই যায় না! দেখা যাবে কী করে—এক কিলোমিটারের চেয়েও দীর্ঘ এই দিঘির
বিস্তার। একটু ছায়া দেখে দিঘির কাছে গিয়ে বসলাম কিছুক্ষণ ভাঙা রাস্তার
ঝাঁকুনির ক্লান্তি দূর করতে। কাছে গিয়ে বসতেই দেখি বড় বড় পদ্মপাতার ওপরে
মুক্তোদানার মতো জলের ফোঁটা সূর্যের আলোর ঝিলিকে ঝলমল করছে। এক–দুটি পাতায়
নয়, শত শত পদ্মপাতার ওপরে এমন জলের ঝিলিক পুরো দিঘিকেই যেন এক মুক্তোর
আঁধার বানিয়ে ফেলেছে! কতক্ষণ ঠায় বসে ছিলাম জানি না। তবে দিঘির অপর পাশের
শালবনের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোর ঝলকানি চোখে পড়তেই উঠে পড়েছিলাম। রোদ থেকে
উঠে পড়ে এবার দিঘির পাড় দিয়ে ধীর ধীরে হেঁটে যেতে শুরু করলাম, শুরু থেকে
শেষ পর্যন্ত।
দিঘিরপাড়ে দৃষ্টিকটুভাবে গজিয়ে ওঠা দোকান পার হয়ে সামনে চললাম। নানা রকম
গাছে ঘেরা দিঘির পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক সময় নিয়ে অন্য পাশে চলে গেলাম।
দীর্ঘ দিঘির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যেতেই আরেক মুগ্ধতা। মনে পড়ল সেই
গানটা ‘ওপারে তে বন্ধুর বাড়ি/ এপারেতে আমি/ মাঝখানে...’, মাঝখানে ভরা গাঙ
নয়, কাঁটাতারের বেড়া। দিঘির যেখানে শেষ, ঠিক সেই পাড় থেকে ভারতের সীমানা
শুরু! কেউ জানাতেও পারল না ওপারে ভারতের কোন জায়গা, নাম কী? যদিও সেখানে ২৪
ঘণ্টা বিজিবি মোতায়েন করা আছে।
দিঘির অন্য পাড়ে চলে গেলাম সীমানা ধরে। যে পাড়ের মুগ্ধতা আরও অনেক অনেক
বেশি। পদ্মগুলো যেন এপাড়েই বেশি আকর্ষণীয়, বেশি মাধুর্য ছড়ানো আর অনেক বেশি
আভিজাত্যের সম্মোহনী সৌন্দর্য নিয়ে জলে ভেসে আছে। একদম দিঘির পাড় ঘেঁষে
পদ্মফুলের শুরু। এপাড়ে আছে শাল, কড়াই, চাপালিশ, পীতরাজ, বাবলা, গর্জনের বন।
পাড়জুড়ে ছায়াঘেরা পথ, বসার জন্য গাছের গুঁড়ি আর ইট–পাথরের বেদি। আছে ঘাটে
বাঁধা ছোট ডিঙি নৌকা। নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে ঘুরে আসা যায় টলটলে দিঘির
ঢেউহীন জলে। ছুঁয়ে দেখা যায়, শিহরিত হওয়া যায় সাদা-গোলাপি পদ্মের কোমল
শরীর। হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়া যায় পদ্মপাতায় জমে থাকা মুক্তোদানার মতো জলের
বিন্দু।
এভাবে কখনো বসে, কখনো হেঁটে, কখনো ডিঙি নৌকায় ভেসে ভেসে কখন যে বিকেল
গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। সূর্য যখন দূর গগনে অস্তমিত তখন ইচ্ছে না থাকা
সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে ফেরার পথ ধরতে হয়েছিল। সারা দিন থাকতে না পারার আক্ষেপ
থেকে গেল। তবে মনে মনে ঠিক করেছি, এরপর নওগাঁ গেলে পুরো একটি দিন কাটাব এই
লুকানো আভিজাত্যের আলতাদিঘির পাড়ে, গাছের ছায়ায়, জলের খেয়ায়।
পদ্মবনের আলতাদিঘি আমাদের এক লুকানো আভিজাত্য!
ঢাকা, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, যেখান থেকেই আসুন না
কেন, আপনাকে যেতে হবে ধামুইরহাট। কালুপাড়া সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে নেমে যাবেন
বাস থেকে। এরপর অটোরিকশায় তিন থেকে চার কিলোমিটার ভেতরে গ্রাম, বন, সবুজ
ধানখেতের ভেতর দিয়ে গেলেই পেয়ে যাবেন আলতাদিঘি।